প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজ প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টায় সচেষ্ট ছিল। মৎস আহরণ, কৃষিকাজ, পশু শিকার, পণ্য বিনিময়, উৎপাদন প্রচেষ্টা প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল। এর মূলে যে জিনিস কাজ করে তাহলো মানুষের অভাববোধ। অভাব পূরণের লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা চালায় । মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেনকে ঘিরেই উদ্ভব হয় ব্যবসায়ের।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
সাধারণভাবে কোনো কিছু কেনা-বেচার কার্যক্রমকে আমরা ব্যবসায় হিসাবে জানি। কিন্তু শুধুমাত্র কেনা-বেচার সাথে ব্যবসায় সম্পৃক্ত নয়। ব্যবসায় হলো উৎপাদন, বণ্টন এবং উৎপাদন ও বণ্টনের সহায়ক কার্যাবলি। আমরা ব্যবসায়কে একটি ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারি-
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ব্যবসায় বলে। পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা, হাঁস-মুরগি পালন করা, সবজি চাষ করাকে ব্যবসায় বলা যায় না। কিন্তু যখন কোনো কৃষক মুনাফার আশায় ধান চাষ করে বা সবজি ফলায় তা ব্যবসায় বলে গণ্য হবে। তবে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যবসা বলে গণ্য হবে যদি সেগুলো দেশের আইনে বৈধ ও সঠিক উপায়ে পরিচালিত হয়। মানুষ তার অভাব পূরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্য বা সেবা উৎপাদন, বণ্টন, উৎপাদন ও বণ্টনের সহায়ক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এবং মুনাফা অর্জন করে। এ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমকেই ব্যবসায় বলে ।
সমাজ বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে ব্যবসায় পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও বণ্টন কার্যাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এরূপ কার্যাবলির কতকগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যা নিে উপস্থাপিত হলো—
অভাব পূরণের প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার উৎপাদন ও বণ্টন এবং এর সহায়ক যাবতীয় কার্যাবলি ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ হতে আরম্ভ করে তৈরি পণ্য বা সেবা ভোক্তার হাতে পৌছানো পর্যন্ত সকল কার্যাবলিই ব্যবসায়ের আওতা বা পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
শিল্প উৎপাদনের বাহন। যে কর্ম প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এর উপযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্য প্রস্তুত করা হয় তাকে শিল্প বলে। শিল্পের বৈশিষ্ট্য সমূহ—
শিল্পকে নিম্নোক্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
প্রাথমিক শিল্পে কোনো রূপগত পরিবর্তন ঘটে না । প্রাথমিক শিল্পকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে ।
যে প্রক্রিয়ায় সম্পদের রূপের পরিবর্তন ঘটে তাকে গৌণ শিল্প বলে । নিম্নে গৌণ শিল্পের সম্ভাব্য আওতাগুলো তুলে ধরা হলো—
এ প্রক্রিয়ায় একাধিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সংযোজন করে নতুন পণ্য তৈরি করা হয়। যেমন-মোটর শিল্প, রেল ইঞ্জিন।
শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রকৃত ভোগকারীর নিকট অথবা কাঁচামাল ও অর্ধ প্রস্তুত পণ্য পরবর্তী ভোগকারী বা উৎপাদকের নিকট পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রতিবন্ধকতাকে দূরীকরণের জন্য গৃহীত যাবতীয় কাজের সমষ্টিকে বাণিজ্য বলে ।
১. পণ্য সংগ্রহ ও বণ্টন: পণ্য উৎপাদন হয় এক স্থানে এবং ভোগ হয় বিভিন্ন স্থানে । বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বীমা, ব্যাংকিং ও প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ঐ সমস্ত পণ্য সংগ্রহ করে বণ্টন করে ।
২. উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়: বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বাণিজ্য বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে ।
৩. ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ: বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, ব্যাংক, বীমা ও প্রচারের দ্বারা যথাক্রমে ব্যবসায়ের ব্যক্তিগত, স্থানগত, কালগত, অর্থ সংক্রান্ত, ঝুঁকিগত বাধা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায়কে চলতে সাহায্য করে ।
৪. পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ ও সংরক্ষনঃ পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে
বাণিজ্য প্রমিতকরণ, পর্যায়িতকরণ, চিহ্নিতকরণ, মোড়কিকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে ।
৫. বৃহদায়তন উৎপাদনে সাহায্য: বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত হয় বলে উৎপাদক অবিরত উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থেকে বাজারের চাহিদানুযায়ী ব্যাপক আকারে উৎপাদন করতে পারে ।
বিনিময় (Trade): পণ্য দ্রব্য বা সেবা সামগ্রির স্বত্ব হস্তান্তরের কাজকে পণ্য বিনিময় বলে। বিনিময়ের মাধ্যমে স্বত্ব হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যক্তিগত বাধা অপসারিত হয়। পণ্য বা সেবা বিনিময়কে নিম্নোক্ত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ।
১. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (Home Trade): একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে ক্রয় - বিক্রয় কার্য সম্পাদিত হয়, তাকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বলে । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে প্রকৃতি অনুযায়ী আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।
i. পাইকারী ব্যবসায় (Whole sale trade): যে ব্যবসায় পাইকারি ব্যবসায়ী উৎপাদকের নিকট হতে অধিক পরিমাণে পণ্য দ্রব্য ক্রয় করে সেগুলো ছোট ছোট লটে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে তাকে পাইকারি ব্যবসায় বলে ।
ii. খুচরা ব্যবসায় (Retail trade): খুচরা ব্যবসায়ী পাইকারদের নিকট থেকে পণ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে সেগুলো ভোক্তাদের নিকট বিক্রি করে । এরূপ ব্যবসায়কে খুচরা ব্যবসায় বলে ।
২. আন্তর্জাতিক/বৈদেশিক বাণিজ্য (Foreign trade): এক দেশের সাথে অন্য দেশের বাণিজ্য হলে তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে। এ ব্যবস্থায় এক দেশের ক্রেতা অন্য দেশের বিক্রেতার সাথে বাণিজ্য করে থাকে । বৈদেশিক বাণিজ্য তিনটি উপায়ে হয়ে থাকে—
i. আমদানি (Import): অন্য দেশ থেকে পণ্য কিনে নিজ দেশে নিয়ে আসার কাজকে বলে আমদানি ।
ii. রপ্তানি (Export): রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য দ্রব্য বা সেবা স্বদেশ থেকে বিদেশে প্রেরণ করা হয় ।
iii. পুনঃরপ্তানি (Re-export): এক দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য তৃতীয় দেশে বিক্রি করা হলে তাকে পুনঃরপ্তানি বাণিজ্য বলে ।
সহায়ক কার্যাবলি (Auxilaries to trade):
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে শিল্প ও বাণিজ্যে সহায়তা দানের লক্ষ্যে যেসব কার্য সম্পাদিত হয় সেগুলোও ব্যবসায়ের আওতাধীন ।
সহায়ক কার্যাবলি নিম্নরূপ—
i. ব্যাংকিং (Banking): ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সরবরাহ করে ব্যবসায়ের অর্থ সংস্থানজনিত প্রতিবন্ধকতা দূর করে ।
ii. বিমা (Insurance): ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ঝুঁকি সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সহায়তা করে বিমা ।
iii. পরিবহন (Transportation): পরিবহন পণ্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্থানগত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করে থাকে। পরিবহন তিন উপায়ে হয়ে থাকে-স্থল পথে, জল পথে, বিমান পথে ।
iv. গুদামজাতকরণ (Warehousing): এ প্রক্রিয়ায় পণ্য কিছু সময়ের জন্যে মজুত রেখে সময়গত উপযোগ সৃষ্টি করা হয়।
v. প্যাকিং (Packing): পণ্য বাজারজাতকরণের আগে পণ্যের দাম, গুণ, তারিখ ইত্যাদি সংবলিত একটি আকর্ষণীয় মোড়কে পণ্যকে সাজানো হলে একে প্যাকিং বলে।
vi. বাজারজাতকরণ প্রসার (Promotion): পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন হওয়ার জন্য, যে উদ্দেশ্যে পণ্য তৈরি করা হয়েছে এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যকে বাজারজাতকরণ করা হয়। বাজারজাতকরণের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হলো-পণ্য গবেষণা, বাজার গবেষণা, বিক্ৰয়িকতা।
অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে যেসব কার্য সরাসরি সম্পাদিত হয় কিংবা দৈহিক বা মানসিক শ্রমের বিনিময় করা হয় তাকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে।
প্রত্যক্ষ সেবার বৈশিষ্ট্য:
১. অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকে,
২. পণ্য ছাড়া সরাসরি সেবা প্রদান,
৩. সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতার উপস্থিতি থাকতে হয় ।
প্রত্যক্ষ সেবার আওতা বা প্রকারভেদ
যেসব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ সেবার মধ্যে পড়ে সেগুলো হলো-চিকিৎসা বৃত্তি, আইন বৃত্তি, হিসাব বৃত্তি, প্রকৌশলী বৃত্তি, পরামর্শ বৃত্তি, হোটেল, সেলুন, নাট্যশালা, সিনেমা হল, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়, ডাক্তাররা মিলে ক্লিনিক ব্যবসা বা কয়েকজন উকিল মিলে এটর্নি ফার্ম বা প্রকৌশলীরা মিলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গঠন করতে পারেন; যা প্রত্যক্ষ সেবা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঙ্গত কারণে ব্যবসায়ের আওতায় আসে । পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসায়ের আওতা অত্যন্ত ব্যাপক। বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায় একটি ব্যাপক আওতাবিশিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। মানুষের অফুরন্ত অভাব পূরণের জন্য বস্তুগত ও অবস্তুগত সেবা ও শ্রমের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই মানুষের এসব চাহিদা পূরণের জন্য অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত যাবতীয় কার্যই ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত ।
বাংলাদেশ শিল্পে অনগ্রসর একটা দেশ। প্রাচীন কাল থেকেই কৃষি খাত এ দেশে মুখ্য হলেও বর্তমানে শিল্পোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় সম্পদ ও গৃহীত বৈদেশিক ঋণের বড় পরিমাণ অর্থ শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু প্রত্যাশিত অগ্রগতি নানান কারণেই এখনও অর্জিত হয়নি।
বাংলাদেশে শিল্পের সমস্যা (Problems of Industry in Bangladesh):
বাংলাদেশে শিল্পখাতে দূর্বলতার পিছনে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। সৎ ও যোগ্য উদ্যোক্তার অভাব: আমাদের দেশের সকল পর্যায়েই দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তা বা সংগঠকের অভাব লক্ষনীয়। অথচ উদ্যোক্তা হলো ব্যবসায়ের নেতা। যোগ্য উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে না উঠার কারণে এ দেশের শিল্প ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে
না ।
২। ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাঃ শিল্প নিজে চলতে পারে না। ব্যবস্থাপনার উপর তাকে নির্ভর করতে হয় । শিল্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এর ব্যবস্থাপকদের যেরূপ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন আমাদের দেশে তার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয় ।
৩। মূলধনের অভাব: শিল্প ছোট বড় যে ধরনেরই হোক না কেন তাতে যদি কাম্য পরিমাণের মূলধন সংস্থান করা না যায় তবে তা হতে কাঙ্খিত ফল লাভ করা যায় না ।
৪। সরকারি সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবঃ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের যে সুষ্ঠু নীতি-পরিকল্পনা ও তদনুযায়ী উদ্যোগ এবং সহযোগিতা থাকা প্রয়োজন তারও মারাত্মক অভাব এ দেশে লক্ষণীয়।
৫। উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতার অভাব: আমাদের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরাতন যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে। ফলে বিদেশি প্রতিযোগীদের ন্যায় মানসম্মত পণ্য উৎপাদন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ব্যবসায় পরিচালনা ও উৎপাদনে যে ধরনের কলাকৌশল ও পদ্ধতি এখানে ব্যবহৃত হয় তাও উন্নত নয়। ফলে ব্যবসায় সংগঠনগুলোর দক্ষতার মান উন্নত হওয়ার সুযোগ কম ।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনশক্তির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই । প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ বাজার, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি, উন্নতমানের কয়লা খনির সন্ধান লাভ, রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বেসরকারি উদ্যোগ সম্প্রসারন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের প্রয়াস, বিশ্বায়নের প্রভাব ইত্যাদি সবকিছুই এদেশে শিল্পখাতের অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয় । দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শিল্পখাতের উন্নয়নের আবশ্যকতা ও করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব যত দ্রুত সৃষ্টি হয় ততই তা মঙ্গলজনক। সর্বোপরি দেশীয় উদ্যোগ ও বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে সকল বাধা-বিপত্তি দূর করে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। যে কারণে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরও এদেশে বাণিজ্যের কাঙ্ক্ষিত সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নে এরুপ সমস্যাসমূহ উল্লেখ করা হলো—
ক. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সমস্যা: (Problems of home trade)
খ. বৈদেশিক বাণিজ্যে সমস্যা: (Problems of foreign trade )
বাংলাদেশে বাণিজ্যোর সম্ভাবনা যথেষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডের পণ্যের সম্প্রসারণ, খুচরা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, মোড়কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্ৰত্যক্ষ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা প্রসার ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রামীণ বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে বিধায় লেনদেন অনেক সহজ হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ভোগের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। মানুষের রুচি ও চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ডিজাইন ও মানের পণ্য বাজারে আসছে। রাজধানি থেকে শুরু করে ছোট শহর পর্যন্ত বিপনি বিতান গড়ে উঠায় বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটছে। রপ্তানি বাণিজ্যে বিদ্যমান সমস্যা মাথায় রেখে আমদানিকারকদের মনে আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিদেশি বাণিজ্যিক মিশনগুলোকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরিন ও বৈদেশিক বাণিজ্য ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রচলিত ব্যবসায় আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবসায় আমাদেরকে স্বার্থপর করে তোলে। অপরদিকে সামাজিক ব্যবসায় আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কীভাবে ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা যায়। মুনাফা অর্জনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ব্যবসায় সম্প্রসারণ এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখায় বর্তমান বিশ্বে সামাজিক ব্যবসায় ধারণাটি ব্যপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ধারনাটি প্রথমে উপস্থাপন ও উন্নয়ন করেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ মোঃ ইউনুস। তিনি ২০০৮ সালে তার প্রকাশিত বই “Creating a world without poverty social business and the future of capitalism” সর্বপ্রথম এ ধারনাটি দেন। পরবর্তিতে ২০১০ সালে তার প্রকাশিত “Building Social Business: The new kind of Capitalism that serve humanity's most pressing needs” এ এই মডেলটির বিস্তারিত আলোচনা করেন।
সামাজিক ব্যবসায় হচ্ছে একটি কারণ ধাবিত (Cause-driven) ব্যবসায়। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারী ধীরে ধীরে তার বিনিয়োগকৃত মূলধন তুলে নিতে পারে। কিন্তু এর বাইরে কোনো লভ্যাংশ সে ভোগ করতে পারে না। এ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসায় পরিচালনার মাধ্যমে সমাজের এক বা একাধিক সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জন করা; এখানে বিনিয়োগকারীর কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থাকে না। এ ব্যবসায়ের মুনাফা ব্যবহার করা হয় সামাজিক ব্যবসায় সম্প্রসারণ বা পণ্য উন্নয়নে। এ কারণেই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো মুনাফা উত্তোলন করে না ।
পণ্যের খরচ তুলে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি এ ব্যবসায় এক বা একাধিক সামাজিক উদ্দেশ্য যেমন—গরীবদের স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ব্যবস্থা, আর্থিক সেবা প্রদান, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থা করা, নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা ইত্যাদি অর্জন করতে সহায়তা করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন— ইত্যাদি।
সামাজিক ব্যবসায়ের প্রকারভেদ (Types of Social Business): সামাজিক ব্যবসায় দুপ্রকার। যথা—
১. টাইপ-I: সামাজিক ব্যবসায়
২. টাইপ-II: সামাজিক ব্যবসায় ।
১. টাইপ-I: এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক, নৈতিক অথবা পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো পণ্য সরবরাহের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যেমন-গ্রামীণ ডানোন (Grameen Danone), গ্রামীণ শক্তি (Grameen Sokti)।
২. টাইপ-II: এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় মুনাফানির্ভর ব্যবসায় যেটির মালিক হবেন গরিব বা সমাজের নিম্নবিত্তরা যারা সরাসরি লভ্যাংশ ভোগ করতে পারে বা পরোক্ষভাবে সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। যেমন: গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ব্যবসায় অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক সামাজিক দায়িত্ব থেকে ভিন্ন ।
সামাজিক ব্যবসায়ের নীতিমালা (Principles of Social Business)
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং হ্যানস রেইটজ ( Hans Reitz), সামাজিক ব্যবসায়ের ৭টি নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছেন । সেগুলো হলো—
পণ্য বা সেবা উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য বা সেবা সামগ্রী ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যাবতীয় কার্যাবলি ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত । ভোক্তা বা ক্রেতার সন্তুষ্টি অর্জনই ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ।
নিম্নে ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিসমূহ বর্ণনা করা হলো—
প্রমিতকরণ হলো মৌলিক মান নির্ধারণ এবং পর্যায়িতকরণ হলো উক্ত প্রতিষ্ঠিত মান অনুযায়ী পণ্য দ্রব্য ভাগ বা শ্রেণিবদ্ধ করা । ব্যবসায়ে পণ্য-দ্রব্য উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে প্রমিতকরণ ও পর্যায়িতকরণে প্রয়োজন পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে যাবতীয় বৈধ অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপই হলো ব্যবসায় আর ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডই হলো ব্যবসায়ের কার্যাবলি। সম্পাদিত কার্যাবলির মধ্যে যেসব কাজ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেগুলো ব্যবসায়িক কার্যকলাপের আওতায় পড়ে। প্রকৃতপক্ষে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যা করে তাই ব্যবসায়ীক কার্যকলাপ ।
বর্তমান উন্নয়নশীল বিশ্বে দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবর্তনের জন্য ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য যোগাযোগ, পরিবহন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্নয়নের সাথে ব্যবসায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিম্নে ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো—
ক. অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic Importance):
খ. সামাজিক গুরুত্ব (Social Importance):
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বে মানব গোষ্ঠীর সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সভ্যতার ক্রমোন্নতিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা আহরণ, উৎপাদন ও বিতরণ সংক্রান্ত কার্যক্রমে ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
যে কোন দেশের জন্য ব্যবসায় হচ্ছে অর্থনীতির মূখ্য চালিকা শক্তি। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌছাতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কৃষিনির্ভর দেশ হলেও এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা, , ব্যক্তিগত ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, মূলধন গঠনে সহায়তা, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মানবসম্পদের উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান ব্যাপক ও অনস্বীকার্য।
কোনো বিশেষ বিদ্যায় বৃত্তিমূলক জ্ঞান আহরণ করে পারদর্শিতা ও দক্ষতা অর্জনের পর বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ ও ব্যবহারের দ্বারা জীবিকা নির্বাহের প্রচেষ্টাকে পেশা বলে । কোনো মানুষ তার জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কোনো কাজকে অবলম্বন করলে সেটা পেশা হিসেবে গণ্য হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায়কে পেশা বা জীবিকা অর্জনের উপায় বলতে পারি । কারণ একজন ব্যক্তি ব্যবসায় করে তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অভাবসমূহ পূরণ করছে। ব্যবসায় মানুষের জীবিকা অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায়। যেকোনো ব্যক্তি তার স্বল্প বা বেশি মূলধন নিয়ে সহজেই ব্যবসায় করতে পারে । তাই অনেকে ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ব্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কেউ যদি চাকরি করে তবে সে নির্দিষ্ট বেতন পায়। সেক্ষেত্রে তার চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা সীমিত হয়ে থাকে। কিন্তু কেউ যদি ব্যবসায় সঠিকভাবে করতে পারে তবে সে চাকরির চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারবে। এখানে তার উপার্জন সীমিত থাকে না। ব্যবসায় কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি দেশে যত বেশি ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ঘটবে তত বেশি মানুষের কর্মের সংস্থান হবে।
ব্যবসায় হলো স্বাধীন পেশা বা বৃত্তি। একজন ব্যবসায়ী বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে, সেখান থেকে মুনাফা অর্জন করতে পারে, এজন্য কোনো জবাবদিহি কারও নিকট করতে হয় না । তাই স্বাধীন পেশা হিসেবে ব্যবসায়কে সবাই পছন্দ করে।
আরও দেখুন...